নতুন সংসারে...
সকাল বেলার ভোরে যে নিগূড় আহবান, নতুন করে পথচলা শুরু করা -সব ঝেড়েঝুড়ে পুরাতন গ্লানি আর হতাশার অপ্রাপ্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে জীবনপানে ছুটে চলা, পথের বাঁকে বাঁকে জীবনের স্রোতধারায় কিছুটা বিস্বাদের বেদনাকে হটিয়ে নিয়ে একটি শুদ্ধ অন্তরে কালবেলার প্রহরে বিলীন হয়ে যাওয়া, এসবই প্রকৃতি ও জীবনের যৌথ শিক্ষা। কেউ কেউ হয়তো খুব বেশি সময় নিয়ে হৃদয় দিয়ে মাপতে পারে না সম্পর্ককে, যদি কখনো দেখতে পায় ভুলে অথবা খেলাচ্ছলে - তো আত্না মুক্তি পায়, ছিন্নভিন্ন পথরেখা থেকে, কালিমা থেকে, অন্ধত্ব থেকে।
Source
বেশ অনেকদিন ধরেই কল্পনা নামক মেয়েটি বেশ উদাসীন হয়ে উঠলো, এমন এক সময়ে যখন তার হাতের কাছে থাকা মানুষগুলো আর তাদের চরিত্রগুলো ক্রমশ রূপ বদলাতে থাকলো। সে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লো, সারাটিক্ষন দুপুরের পর বিকেলবেলা যখন চারপাশ কিছুটা হালকা হয়ে আসে, তপ্ত সূর্যের উত্তাপ কমে গিয়ে নরম রোদের আলোছায়ায় নীরস মাটি সজীবতা ফিরে পায়, মন কিছুটা শান্তি খুঁজে পায় - তেমন এক নির্ঘুম বিকেলে বাগানের কাছে বসে সে খোলা মনে বসে রইলো।
সদ্য সে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পা দিলো, ছোট্ট একটি জীবনের অংশ, বেশ বড় নয় - এ সময়ে সে যে কতকিছু বদলাতে দেখলো, মায়ার বাঁধন ভেঙে নিষ্ঠুরতার ক্রম পটপরিবর্তনের খেলায়, কাছের মানুষের দূরে সরে যাওয়া, ক্ষনিকের ভালোবাসার রেশ ফুরাতে না ফুরাতেই একটি মানুষ তার জীবন থেকে বহুদরে চলে যাওয়া, সে কি খুব নিরেট বিষাদে ডুবে যাওয়া, শোকের বন্হিরেখা সারা অন্তরকে মুষড়ে দিয়ে স্হবির করে রাখা - এসব কিছুই কল্পনা কখনো পুরোপুরি উতরে উঠতে পারে নি।
মেয়েটি কি আশ্চর্য রূপে সাজানো একটি মুখচ্ছবি,অন্তরের ভিতরে একটি প্রদীপশিখা জ্বলছে, চোখ দুটোতে যেন ঢল নেমেছে বৃষ্টির, আষাঢ়ের দিনে যেমন করে নামে, বর্ষাকাজল চোখে যেন মায়া যা দেখে ভালোবাসা ঝরে পড়ে। মেয়েটি তার পাতিলেবুর বয়সের জীবনে তেমন বেশি খুশি দেখতে পারে নি, ঠিক যেদিন তার বর্ষাচোখ নিয়ে জন্ম সেদিন থেকেই বোধহয় স্রস্টা তার জন্য দুঃখ বেঁধে রেখেছে, একের পর এক বিয়োগ ব্যাথায় তার দুখের সীমা রইলো না। তবে সব বিপদে বিপর্যয়ে মা তাকে আগলে রেখেছিল আঁচলে বেঁধে। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কলেজের দিনগুলোতে বাবা কতদিন যে অপেক্ষা করেছে মেয়েটির জন্য, তার পড়াশোনা ও সংসারের হালটা শক্ত করে ধরার জন্য - তার ইয়ত্তা নেই।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও একসময় ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে মুছে যায়, আগের সংখ্যাটি আর চলে না। মেয়েটি যে বাবার সাথে ঘুরতে যেত, সকালে মায়ের কাছে বায়না ধরতো, তাকে নানুবাড়ি নিয়ে যেতেই হবে সপ্তাহের শেষে পাওয়া বড় ছুটির দিনে - সে এখন আর অত সহজে মুখফুটে কিছু বলে না। এবার সে বড্ড বাস্তববাদী, সংসারের ছবি দেখতে পায়, কীভাবে মধ্যবিত্ত পরিবারে থেকে বাবা কষ্ট করে দিনপার করেছে - এখন সে বুঝতে পারে এসব,মনপ্রান দিয়ে অনুভবে, বুদ্ধিতে।
মেয়েটি বড় হচ্ছে, এখন একটি ভালো সম্বন্ধ দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে, নইলে যে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে,মেয়ে উপযুক্ততা হারাবে - এসব চিন্তা সারাবেলা বাবার মনে পড়ে থাকে। তিনি জানেন, তার সমস্ত সঞ্চয় খরচ করে হলেও এ কর্তব্য সমাধা করা তার জরুরি, বোধহয় এর বাইরে এই শেষ বয়সে এসে তার চাওয়া পাওয়া নেই। কঠিন দিনের সারিতে এসে যখন তিনি সম্বন্ধটি পেলেন, তখন যেন বুকের ওপর থেকে একটা পাথরের বোঝা নেমে গেল! এবার ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেবেন, তারপর সুখনিদ্রা গেলেও তার কষ্ট থাকবে না।
বিয়ের লগ্ন এলো, দিনতারিখের কাঁটা জানান দিলো সময় যে হয়ে এলো, এবার নদীতে তরী ভাসাতে হবে, এক ভবিষ্যতের পানে চেয়ে যেখানে কোন কূলকিনারা থাকবে না তরীটি শেষমেষ কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু, তরী যে তাকে ভাসাতেই হবে, তার ব্যতিক্রম হওয়া চলবে না। কল্পনার দুঃখভরা জীবনে যেন এক নতুন অধ্যায় নেমে এলো।
যে বিষম ঝড়ের দিনে মায়ের ছায়াতলে এসে আশ্রয় নিতো, প্রিয় বাবা ছড়া কবিতা পড়ে শোনাত,নানা উপদেশ, আদেশ নিষেধ - এবার বুঝি সব শেষ হতে চললো, মনজুড়ে এখন শুধু কঠোর জীবন উঁকি দিচ্ছে যেন।
একটি সংসার পেরিয়ে আরেকটি সংসার, খুব সহজ এক স্থানান্তর ; কিন্তু জীবনের হিসেবে খুব বড় একটি বিদায়বেলার সন্ধিক্ষণ যেটা একটি মেয়ের জীবনে বড় একটি অধ্যায়। কল্পনা অনুভব করছে নতুন করে ঘর বাঁধা আর আগের জীবনের টান ঢলে পড়ছে, হৃদয়ের বাঁধন ছুটে যাচ্ছে, বর্ষাচোখের কাজল বেয়ে বেয়ে যেন বন্যা নেমেছে, বাবার হাত ধরে কতকাল ধরে বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছে, এবার যেন শেষযাত্রায় ঘরের বাইরে পার করে দিতে মন কেমন করছে। বাবার চোখের কোনে জল কল্পনা কোনদিন দেখে নি, এই প্রথম এই শেষ ; এবার কল্পনা নতুন একটি সংসারে,
সানাই বাজছে,একটানা সে সুর, সন্ধ্যার দীপশিখা থেকে রাত গভীর হয়ে পড়লো।
কোনো কোন গল্প জীবনের কাছ ঘেঁষে স্বল্পেতেই শেষ হয়ে যায়, কিছু ঘটনা অগোচরে থেকে যায়। কল্পনার জীবনেও সেরকম ঘটলো। সে বোধহয় এখন সুখে আছে, নিশ্চিন্তে আছে ; নয়তো কোনো বিকেলে কারো কথা খুব মনে পড়ে যায়, পরিবারের সেই দিনগুলো নিত্যকার কাজ করতে দেয় না, স্মৃতিরা ডানা মেলে আকাশে ঘুরে বেড়ায়, এভাবে দিনগুলো কেটে যায়।কোলাহলে সারা,কাছ থেকে ক্রমশ পর হয়ে যাওয়া, এভাবেই গল্পের শেষ।