কোনো এক ভরা জ্যোৎস্নায়...
মাঝে মাঝে এলোমেলো ভাবনার মাঝে ছুটে আসা স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, সোনালী অতীতের সেই দিনগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি দিন খুব উজ্জ্বল ছিল ; এতোগুলো বছরের সময় ব্যবধান পেরিয়ে, নতুন ঘটনার রেশ আর নিত্যদিনের কাজকর্মের ভীড়ে সবটুকু স্মৃতি ধরে রাখা খুব মুশকিল৷ কিন্তু সে যতই কর্মব্যাস্ত আর অভিজ্ঞতা যোগ হয়ে ক্রমশ হালকা আর অস্পষ্ট করে দিক তার বিবরণ, লিপিবৃত্তান্তের ছক যেটা নাড়া দেয় - কোন এক অবসরের দিনে, ঝিম ধরে বসে থেকে মনে করা - সে বহুকাল আগের এক মুহূর্ত।
Source
সেসময় ছিল ভরা পূর্ণিমার রাত, চাঁদের আলোয় আলোকিত সারাটা মাঠ -প্রান্তর, কাঁচা রাস্তা আর মেঠোপথের ফসলি ক্ষেতজুড়ে সুরসুর বাতাস বইছিলো। চাঁদের নিজের কোন আলো নেই, তা বুঝলাম কিন্তু সে যে এতো আলো প্রতিফলন করে পুরোটা জগতকে মিঠে মোলায়েম আভায় ছাপিয়ে দিবে তা ভাবতে পারি নি৷ গ্রীষ্মের মৌসুম চলছে তখন, আমি বাল্যকালের পুরোটা স্ফূর্তি ধরে রেখেছিলাম, যেথায় খুশি যাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি মনের সুখে, বর্ষা কিংবা শীতের দিনে, হল্লা করে আড্ডা দেয়া আর নিশিভোজের আয়োজনে হারিয়ে যাওয়া, এই ছিলো সেসময়ের দিনযাপন।
আমাদের সবার জীবনে বোধহয় এমন একটি সময় কেটে যায় যখন জীবনের যান্ত্রিক প্রয়োজন তার হাত মেলাতে পারে না, ধরে বাঁধতে পারে না আমাদের, ফেলে রেখে আসতে পারে না কর্কশ ব্যস্তঘন্টার ঠনঠনানিতে, সকাল কিংবা রাতের রোবটিক পুনরাবৃত্তির দাস হিসেবে। প্রাচুর্যের পৃথিবীর নাগরিক সুবিধা হলো এক, আরেকটি হলো ছোট্ট গ্রামটির অন্তরে সুখে-দুঃখে কিছু দিন কাটানো যেখানে প্রাণটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, সে হাসবে খেলবে, মনের সুখে গান গাইবে, প্রকৃতির আতিথ্যের হিড়িকে আনন্দ খুঁজবে - এটি বোধহয় সার্থক জীবনের একটি দিক। ভাগ্যবান আমি যে, এ দিকটির সন্ধান পেয়েছিলাম প্রথম জীবনে।
সন্ধ্যা নামার মুহুর্তে অস্তমিত সূর্যের কম্পমান ফেননিভ আলো স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল, সারস সাদা বকের দল ডানা মেলে ঘরে ফিরছিল, নীড়ের পাখি কিচিরমিচিরে ধ্বনির সুরতরঙ্গে আনছিল সুমধুর এক ভাব, তখন পুরো আকাশ-প্রকৃতিতে এক স্তব্ধতার ভাব। সারি সারি আমবাগানে সবুজ আমের ঘ্রান, বাতাসের কলকল রবে ঠান্ডা স্রোতের সমীরস্নান গায়ে মাখাচ্ছিল এক অপরিসীম ভালোলাগা, এক উন্মুখ ভোমানন্দ, যেন কতকাল ধরে এ মুহূর্তটাকে চিনি।
দিনের শেষে রাত নেমে এলো, সূর্য ডুবলো, উদয় হলো থালার মতো গোল এক চাঁদের যার আলোতে দূরের আকাশটার মাঠজুড়ে উড়ন্ত পরীরা নেমে এসেছিল, কি বাহারি তাদের রূপ সৌন্দর্য, হাসির খলখলানিতে মুখর চারদিক, যেন তারা পেয়েছে পুরো স্থানটাকে,মাঠটাকে,সময়টাকে ; কি খুশির অনুভূতিতে তারা প্রকাশিত, উদ্বেল হয়ে গোল্লাছুটের মতো নৃত্যে মশগুল। সে রাত্তিরে আমি সন্ধ্যার পর ভেবেছিলাম সবুজ ঘাসের ওপর বসে আমার কিছু বাল্যবন্ধুর সাথে আড্ডা দিবো, দিনরাত্রির এই সৌন্দর্যের লীলাভূমে বসে কেচ্ছাকাহিনী শুনাবো৷
যেই ভাবনা সেই কাজ, সারা বিকেল নদীতে সাঁতরানোর পর কাঁচা আমের সাথে পাকা তেঁতুল সহযোগে অম্বল চাটনির মাখানো ফলযোগে যেন জিভে স্বাদ ফিরে এলো। ভেঁপুর বাঁশি, মানিকের সেই বাঁশের বাঁশির সুরের ঝর্ণাধারায় যেন ঝরে পড়ছিল সুরের ধারা, কানে আসছিল ডোবার পাড়ের একটি ব্যাঙের অপর্যায়কালিক নাক ডাকা, কিছু ফসলি ক্ষেত পেরিয়ে সুমনের টংয়ের চায়ের দোকানে বসে হালকা চুমুকের পান৷ সারা প্রকৃতি কেমন নিস্তব্ধতার জালে মোড়ানো, মাঠজুড়ে বওয়া বাতাসের শান্তি, আহা হৃদয় জুড়াতেই যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম।
রাত কিছুটা গভীর হতে থাকলো, ঘাসের ওপর বসে আছি আমরা কজন। পূর্ণিমা রাতের আকাশে যেন তারার দল ঝিকিমিকি করছিলো, দূর থেকে সে কি অপূর্ব দৃশ্য, যেন সারা বেলার মনপ্রান এক হয়ে নিশ্চুপ ভাবনায় এক নিমিষে ডুবে থেকে যদি স্তব্ধ প্রহরে এমনি করে সারারাত কেটে যায় তো মন্দ হবে না আনন্দ। সে পূর্ণিমার আলো যে কত টুকু নিস্তেজ সরল ছিল, জ্যোৎস্নাঢাকা আবহে যেন মনে হচ্ছিল এই বুঝি বিমুগ্ধ হয়ে কোথায় হারিয়ে যাই।
তখন সবে মানুষজন, পাখি, কীটপতঙ্গ ব্যাঙেরা গভীর রাতের ক্লান্তি টের পাচ্ছিল, ঘুমন্ত পরিবেশ যেন থমকে দিল গতিময় আনাগোনা৷ আমার বন্ধুরা সবাই পোড়া শিক কাবাবখানি খেয়ে, কেচ্ছাকাহিনীর বৃত্তান্ত শেষ করে, হাসিঠাট্টা দুষ্ট কথার পালা শেষ করে বসে আছে৷ সারাবেলার এতো দীর্ঘ কোলাহল আর দিনভরের কাজকর্মের ভারে তন্দ্রায় কাতর, ঢুলুঢুলু চোখে ঘুমের রাজ্য ডাকছে, একজন হালকা করে নাক ডাকার ঘোরে হঠাৎ করে আবার জেগে, জুতাপাটিতে পা গলিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে খাটে পিঠ লাগাতে রওয়ানা হলো।
Source
সবাই যখন চলে যাচ্ছিল আমি তখনো পূর্ণিমা রাতের রোমান্টিকতা ভুলতে পারিনি, এমন সময় কবে আর আসবে, এ অনুভূতিতে তখন ঋদ্ধ কিসের ঘুম, কিসের তন্দ্রাচ্ছন্নতা -সারাক্ষন উদাস চোখে গোল চাঁদখানার দিকে তাকিয়ে। এবার আমি পুরোটা মাঠজুড়ে একা, এ পৃথিবীতে যেন কেউ নেই আমার৷ দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি একগুচ্ছ সাদা ফুল ভেসে যাচ্ছে, তার পিছু পিছু কেউ আসছে। তার সাদা ডানা মেলা, বাবল উড়ছে, সুন্দর একখানা মুখ, কি নিখুঁত তার মুখশ্রী আর শোভা বয়ে বেড়াচ্ছে।
পরী নিশ্চয়ই, প্রথমে ঠাহর করলাম, ও যে আলোর রূপে আলোকিত, আমার মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকে দেখছি, আর হাতছানি দিয়ে যেন বলছি, নেমে আয়, নেমে আয়। সে কিছুক্ষণ পর এদিকে ফিরে তাকালো,এবার বুঝতে পারলো আমি তাকে ডাকছি৷ সে যেন আমাকেই খুঁজছিল, এবার দূর থেকে ভেসে আসছিল ; সোজা আমার সাথে ঘাসের ওপর এসে বসলো। কথা বলছি, বলছি, ও যে ভরা জ্যোৎস্নার পুরোটা শ্রী পেয়েছে, তার হাসিতে হৃদয় জুড়িয়ে যায়, কল্পনার চেয়েও শক্তিশালী, সুন্দরী গুনবতী এক পরী।
কিছু সময় পর সম্বিত ফিরে পেলাম একটা ধুপ করে কিছু পড়ার শব্দে,ঘাসবাগানের পাশে বাতাবিলেবু গাছ থেকে ছুড়ে পড়লো একটা বড় সাইজের লেবু, আর আমি জেগে ওঠলাম। পরীও নেই আমিও নেই, শুধু লেবুটা পাশে পড়ে রইলো। ভাগ্যিস মাথায় পড়ে নি, না হলে পরীও থাকতো আমিও থাকতাম, পরীর জগতে৷ হা হা।
কি আর করার, সব রাগ ঐ লেবুটার ওপর ঝাড়তে মন চাইলো, ব্যাটা পুরো ঘুম ভেস্তে দিল। যা হোক, ফলের ওপর কি আর রাগ করা যায়? তারপর, লেবু হাতে হাঁটতে হাঁটতে মাঠ পেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম, ততক্ষণে ভোরের এক চিলতে লালিমারশ্মি দিগন্তরেখায়।
ভাগ্যিস লেবুটা আপনার মাথায় পড়েনি,তা না হলে এই "ভালো লিখা" টা পড়তে পারতাম না।
ভাইরে ভাই,সাধারণ ঘটনাকে সাহিত্যিক ঢং এ উপস্থাপন,অনবদ্য।
😀 হা হা, তা তো বটেই, কিন্ত ঠিক ঘুমের সময়ই, লেবুটা পড়ার আর সময় পেল না!
বাল্যকালের কিছু গ্রামীন স্মৃতির রোমন্থন করে এ গল্পটি লিখলাম৷ ধন্যবাদ আপনাকে, ধৈর্য্য ধরে পড়ার জন্য।
👍
Congratulations @asif7! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):
Your next target is to reach 1500 upvotes.
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Check out the last post from @hivebuzz:
Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!