মায়ায় বাঁধা ঘর।
কিছু জিনিস এ পৃথিবীতে, পুরনো হয় না, আবেদন হারায় না, অনুভূতির নিগড় থেকে দূরে সরে যায় না। মানুষের মন কি বিচিত্র খেয়ালে ভরা, ভাবতেই পুলক জাগে মনে এই ভেবে যে, যখন কোনো কিছুর জন্য নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়, সেই নতুন তাজা সতেজ ভাব সময়ের বওয়া স্রোতে ভেসে জীর্ণ হয়ে গিয়েছে, তারপরো তার প্রতি কি নিদারুণ টান রয়ে গিয়েছে, মোহের আবেশে ঢলে পড়ার স্বভাবে এতটুকুও ভাটা পড়ে নি। এটি একটি অভিজ্ঞতা লব্ধ বিষয় - অনুভূতির একটি নিরেট দিক, যেটি ইচ্ছা করলেও দূরে ঠেলে দেওয়া যায় না,মুছনি দিয়ে মুছেও ঝেড়ে ফেলা যায় না।
চোখের নিচে কালি জমেছে, কপালের ভাঁজে ভাঁজে বয়সের বাঁকা রেখা স্পষ্ট হয়ে পড়েছে, তারুণ্যদীপ্ত দেহখানা কেমন শৈথিল্যভাব পেয়েছে,কাঁচাপাকা চুলগুলোতে শুধু জট বেঁধেছে। পাকা চুল দেখে আঁতকে উঠেছে ইতিহাসের বিজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল্লাহ সাহেব। পরিণত বয়সে যখন প্রৌড়ত্ব ভর করে বার্ধক্যের দিকে যাত্রার উদ্দেশ্যে, তখন মন বেচারা যে স্বভাবতই চিরযৌবনে উদ্ভাসিত,যার বয়স সবসময়ই পঁচিশ -ছাব্বিশ, মধুকালের স্রোতে শ্রেষ্ঠ সময় জীবন আস্বাদনের - শুধুই বয়সটা কমিয়ে রাখতে চায়।
একরাশ গোদরেজ আমলা হেয়ার ডাই এর চিটচিটে কালো রঙে সাদা চুলগুলো অমনি কালো হতে লাগলো। দক্ষিণমুখো জানালাটার পাশ দিয়ে সুনসান হাওয়া বইছে, একরাশ বেলীফুলের ঝাঁকে ভীড় করা প্রজাপতিরা সুঘ্রানে মুখরিত, অধ্যাপক মনে করতে লাগলেন সে বছর কুড়ি আগের দিনের ঘটনা, যেদিন ঠিক এমনি এক বসন্তের দিনে ঝতুরাজের সবটুকু ঐশ্বর্য, রূপ-মাধুর্য আর সুললিত মুখরতা দিয়ে প্রকৃতি সেজেছিল রাণীরূপ সৌন্দর্য দিয়ে। সময় সে বহুদূর চলে গিয়েছে, অনেক কিছু বদল হয়েছে, কিছু জিনিস চিরতরে হারিয়েও গেছে, তবু স্মৃতির কিছু পাতা মুছতে পারে নি।
দিনটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন দিন তাঁর কাছে, সমাবর্তনের শুরু শুরু ভাব, নানা আয়োজনে দীর্ঘ একটি সময়, নতুন যৌবনের দিনে বিদ্যা অর্জনের কাছাকাছি এসে পড়া। তিনি সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছিলেন তাই তাঁর আনন্দটাও অন্যদের চেয়ে বেশি৷ একটি আচার্যের হাত থেকে নেয়া মেডেল, যেটি ছিল সেরা প্রাপ্তি,নতুন করে জীবন শুরু করার এক অমূল্য উপহার, তার খুশিতে চোখ কিছুটা ঝাপসা হয়ে ওঠার মুহূর্তে নতুনভাবে পৃথিবী দেখার শুরু।
Source
সেদিন তার প্রিয়তমা বন্ধুর কাছে সবচেয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া, নিজেকে সেরাদের সেরা হিসেবে উপস্থাপন করতে পারার উৎফুল্লতা, দিনের শেষে বিজয়ী হিসেবে মেলে ধরার আকুল নিঃশ্বাস, চাপা খুশি যেটা তাঁকে স্বপ্নচারী সীমানার সবচেয়ে উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছিল, কৃতিত্বের পরশে তাঁর প্রানের সখা প্রাণখুলে তাকে বাহবা দিচ্ছিল, সবকিছু কেমন যেন একটি দিনের সৌভাগ্যের কারনে পাওয়া -এই বদ্ধমূল মিথ পন্চাশের কোঠার বয়সেও নাড়া দেয় তাঁকে।
জেরিন মেয়েটি সাধারন যেকোন মেয়ের মতোই, শুধু আব্দুল্লাহর চোখে ছিল অসাধারন। চোখের পলকে ছিল এক অদ্ভুত রূপ, মোহনীয় ব্যাক্তিত্বের ছটায় অপূর্ব মুখশ্রী, অলঙকার প্রসাধনী ছাড়াই সুন্দর। যে প্রকৃত সুন্দর সে বোধহয়, রঙে ঢঙে বর্ণের জন্য সুন্দর না, বরং ভেতরের সজীব ভালো একটি মন যেটি কোন ব্যাক্তিকে সুন্দর করে, জেরিনের তেমন একটি প্রান ছিল। আব্দুল্লাহ ছিল গোবেচারা স্বভাবের, তাই মনের কথা বলার মতো সাহস কিংবা স্পর্ধা কখনোই জন্মায় নি। পিছু পিছু সংকোচ, যদি জেরিনের দৃষ্টিতে সে খাপছাড়া বলে বিবেচিত হয়, এই ভয় তাড়া করে ফিরতো।
জেরিন সহজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতো না কারো সাথে, অপরিচিতদের স্বভাবতই এড়িয়ে চলার মতো অন্তর্মুখী একটি চরিত্র ছিল তার৷ আব্দুল্লাহ যতই ঘনিষ্ঠ হতে চাইতো, ততই সে নিজেকে আরো দূরে দেখতে পেতো। মেয়েটি ছিল পিতৃস্নেহ বঞ্চিত, মায়ের কোলেপিঠে মানুষ হওয়া, আর চাচা-জ্যাঠাদের আদুরে ছোট্ট মেয়েটি। যখন বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলো ততদিনে নিজের বুঝ বুঝতে পুরোদস্তুর সমঝদার, অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে বেশ এগিয়ে গিয়ে বাস্তববোধে ঝদ্ধ এক মেয়ে। বাবার অনুপস্থিতিতে নিজেকে ঠিক সামলে নিয়েছে, শক্ত এক পণ করে নিয়েছে মনে মনে, নিজ পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে।
দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো, ওদিকে বেশ কিছুদিন জেরিনের খোঁজ পেল না আব্দুল্লাহ। সে কথা পর্যন্ত বলতে সাহস করতে পেতো না, কারন প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব পাবে না এ রকম সমীকরনে পর্ব অগ্রসর। জেরিন শুধু নিজের পরিবারকে আগে নিয়ে আসে,বাকিসব কিছু তুচ্ছ তার কাছে। জীবনের সম্পর্কের ছকটাকে দৈবভাবে বাড়াতে চায় না সে, কেবল যেটুকু গন্ডির জীবন তাকেই উন্নত পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, মোটের ওপর একটি মাঝারি স্বপ্ন নির্মান করার বাসনা ছিল সবসময় জাগ্রত। এর মাঝামাঝি ব্যাক্তিগত কোনো কিছুই জড়িয়ে পড়তে না দিতে দ্বিধাহীন এক মেয়ে, জেরিন।
দিন পার হয়ে মাসের কোলে বছর পেরিয়ে গেল। আব্দুল্লাহ এতটুকু বুঝতে পারলো দীর্ঘ নিরীক্ষণের শেষে, যে মেয়েটি কখনো নিজের প্রতিজ্ঞা সহজে ভাঙবে না, যদিনা সমীকরনের অন্য কোন নিকল্প সমাধান খোঁজা যায়। সে বুঝতে পারে, জেরিন তাকে ভালোবাসে কিন্তু তা যে পথের কাঁটা, তার জন্য নিজ পথে জেরিন সবসময় হাঁটে, কখনো অন্য পথে যায় না। তারপর, আব্দুল্লাহ আর কখনো সে পথে যায় নি।ধীরে ধীরে সময় শেষের কিনারায় এসে পড়লো।
শেষের আগে মাঝে মাঝে দেখা হতো, কিন্তু নীরব বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা, শূন্যতার এক হিম হাওয়ার সাথে চলে যাওয়া। জীবনে তবু একটি আলো দেখা মিললো কোন এক মেঘে ঢাকা দিনে। জেরিন ক্লাস শেষে ঈশান কোনের ব্যালকনিতে বসে আছে, চিন্তিত আর নীরব। অভিভাবকহীন একটি মেয়ে যে পিতৃকুলের সব মানুষের চক্ষুশূল হয়ে রয়েছে, বাবার সম্পত্তিতে ভাগের ভোগ দখলে ঘরহারা। তার যে কোথাও ঠাঁই নেই।
Source
ঠিক সেদিন সকালেই আব্দুল্লাহর রেজাল্ট বেরোল, এবার সে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সাহায্যকারীর দায়িত্ব নেয়ার অফার পেল। জেরিনের এই অবস্থা দেখে, তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে যাকে ভালোবাসে,সে যে এখন আশ্রয়হীন, বাবার স্নেহ মমতা কবেই হারিয়েছে, তাকে আর কোথাও না হোক, তার হৃদয়ে স্থান দিতে সে পারবে না তা হয় নাকি? এই প্রথমবার দীর্ঘ নীরবতা ভেঙে জেরিন কথা বললো, আব্দুল্লাহ তাকে নিশ্চিন্ত করলো।
তারপর কোনো সম্পর্কের মধুর পরিণতি যা হয় তাই ঘটলো, গোলাপ বাগানের গাছের সারিতে ফুলের দেখা মিললো, মাঝে অনেক বছর পার হয়ে গেছে, বিশ বছর। আবার অধ্যাপক সাহেবের জানালার পাশ দিয়ে বেলীফুলের ঘ্রান ছড়িয়ে গেলো পুরো বাড়িতে, সে দিনের কথাও মনে পড়লো, বেলা ডুবলো।
কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর আগেই মায়া জন্মায়। মায়া থেকে খুব সহজেই পালিয়ে যাওয়া যায় না। গল্পের শেষ পরিণতি যদি ভালবাসার সমাপ্তি হয় তাহলে হয়তো আর কিছুই প্রয়োজন হয় না। জেরিনের ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে আর আশ্রয় মিলেছে সব থেকে নিরাপদ জায়গায়।
এটি সম্ভবত আপেক্ষিক, ভালোবাসা কিঞ্চিৎ থাকলেই তবে মায়া জেগে ওঠে, একটির সাথে আরেকটি জড়ানো। ঠিক আলাদা করা দুরূহ ব্যাপার।
এটি নিখুঁত সত্য একটি কথা,আব্দুল্লাহ শেষকালে এসে পারে নি কিছুটা বিদ্বেষ রেখে পালিয়ে যেতে, সে সত্যিকারে ভালোবাসে, তাই মায়া ধরে রেখেছিল।
পূর্ণতা পেয়েছে দেখে ভালো লাগা, তার চেয়ে বেশি খুশি লাগা এই ভেবে যে মেয়েটি তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে, প্রথমে নিজ পরিবারকে মূল্য দিতো বেশি,এবার যখন প্রথমটি ভেঙে গেল, তারপর ভালোবাসায় স্থায়ী পরিবারটিতে যেতে পেরেছে।
এতো সুন্দর মতামতের জন্য কৃতজ্ঞ,ধন্যবাদ আপনাকে, 💝।।